লেখক-আমজাদ হোসেন
ধরন-উপন্যাস
পৃষ্ঠা-১৯২
মুল্য-২২০ টাকা
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স
ভাদ্র মাসের বৃষ্টি যেমন, গল্পের চরিত্র মংলুর ভাগ্যটাও তেমনি। ভাদ্র মাসের বৃষ্টিকে লোকে বলে "উড়াবৃষ্টি"। ঝড়ের মতোই উড়ে আসে ঘন্টাখানেক ইচ্ছা মতো নাচানাচি করে আবার হঠাৎ করেই উধাও। এই বৃষ্টির জলখেলা কেউই বুঝতে পারে না। মংলুর ভাগ্য-আকাশ তেমনি, ঝড়ো দুঃখ-সুখের লীলায় পরিপূর্ণ। একটুখানি সুখরৌদ্রের দেখা পেলেই দুঃখের মেঘ ছুটে আসে।
মংলুর জন্ম হয়েছিলো কোন এক মঙ্গলবারে। সেকারনে তার নাম রাখা হয় মঙ্গল। কিন্তু এ নাম বিকৃত হয়ে হয় "মংলু"।
জগৎ সংসারে সে একা। বাবার মৃত্যুর কাহিনী মায়ের কাছে শুনেছে বহুবার। বাবার চেহারা তার মনে পড়ে না। সাত আট বছর মাকে পেয়েছিলো। এক সময় মাকে হারায় ব্রক্ষ্মপুত্রের কোলে। অন্যের আশ্রয়ে বড় হয় অনাথ মংলু।
যৌবন কালে সে ছিলো অসুর শক্তির অধিকারী। ছয় ফুট লম্বা যুবকের চওড়া বুক।গায়ের রং অধারের মতো কালো। পেটানো শরীর। মাথায় বাবরী। হা-ডু-ডু খেলায় জুড়ি মেলা ভার! চোখদুটো তীক্ষ ছোট ছোট। রেগে গিয়ে সে যদি কাউকে চড় মারতো, সাথে সাথে লোকটা নিচে পড়ে যেতো। ছিলো একগুয়ে।জিদ আর গোয়ার্তুমিতে সেরা।কিন্তু তার বাঁশিতে সুর উঠতো অসাধারণ! সে সুরের গুনে পেয়েছিলো তার আয়নাকে।
মুক্তিযোদ্ধা ছিলো এই মংলু। একজন নিরক্ষর বকলম মুক্তিযোদ্ধা, যে ক্ষেত খামারের দিন-মুজুরির কাজ ফেলে চলে গিয়েছিল যুদ্ধে। অন্তঃসত্ত্বা বউকে রেখে গিয়েছিলো অন্যের আশ্রয়ে। তার ছ'ফুট লম্বা কালো কুচকুচে চেহারা দেখলেই মিলিটারীরা চমকে উঠত।
এই গল্পটা মংলুর, মংলুর আয়নার, মংলুর স্বাধীনের। প্রতি পাতায় ছেয়ে আছে এক গেয়ো, গুয়ার দিনমজুরের আঁচড়। নখের আঁচড়ের ক্ষত থেকেও এ যন্ত্রণার তীব্রতা অধিক! একজন এতিম অনাথ মুক্তিযোদ্ধার দিনলিপি। যাকে মুক্তিযোদ্ধা বলে সবাই সমীহ করে চলত। কেউ কাজ করতে দিতো না, পাছে সম্মানে ভাটা পরে। যাকে দেখার জন্য মৃতপ্রায় এক বৃদ্ধ বেঁচে ছিলো তিন দিন। যাকে ছু্ঁয়ে দেখার স্বাদ ছিলো গেয়ো অশিক্ষিত গ্রাম্যলোকগুলোর ! উপন্যাসের পাতা জুড়ে সেই অসহায় মুক্তিযোদ্ধার আলাপে পরিপূর্ণ। সে তার সন্তানকে কসম করিয়েছিলো, কোন দিন যেন কেউ জানতে না পারে তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এ কথা যেন সে বলে না বেড়ায়। এত অভিমান! এত আক্রোশ! কিন্তু কেন?
ছ'ফুটের চওড়া বুকের অধিকারী মংলু আড়াল হতে চেয়েছিলো এই নাম মাত্র উপাধি "মুক্তিযোদ্ধা"র খোলশ থেকে।
আমজাদ হোসেন। তিনি ছিলেন অভিনেতা, লেখক এবং ব্যতিক্রমধর্মী চলচ্চিত্রকার। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন কিশোর। উনসত্তুরে গনঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তিনি প্রতক্ষ্য ভাবে জড়িত। তার লেখা চলচ্চিত্র " জীবন থেকে নেয়া" মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ যুগিয়েছে বিপুল ভাবে। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন "বাংলা একাডেমী পুরস্কার"।
উত্তরকাল এর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত! যেমন তার ভাষাচিত্র, তার থেকে মনোহর বর্ণনাভঙ্গী। এত পরিপাট্য আর সাবলীল গতি প্রশংসার দাবী রাখে অবশ্যই। লেখকের কলমে এত সুন্দর করে ফুটে উঠেছে প্রকৃতি এবং চরিত্র গুলোর বাস্তব চিত্র!
পোড় খাওয়া সংগ্রামী মানুষের চিত্র এঁকেছেন লেখক।
প্রথম পাতাতেই আটকে ছিলো চোখ অনেকক্ষন, " একটানা ক'দিন ঝুপঝুপা বৃষ্টির পরে, গ্রামগঞ্জের কারো কারো কাছে আজকের ঝলমলে রূপালী রোদ সোনার চেয়েও দামি মনে হচ্ছে।"
আমার মতো আবেগপ্রবণ পাঠককের চোখে জল আনা লেখকের কাছে কোন ব্যপারই ছিলো না। ক্ষোভ আরও চড়ে গিয়েছিলো একারনে যে, আমি নিজ থেকে উপলব্দি করতে পেরেছিলাম, আমি যা পড়ছি তা একবিন্দু মিথ্যা নয়। ঠিক তাই ঘটেছে, এবং একবার নয় বহুবার, বহুবার। হয়তো জায়গা আর চরিত্র বদল হয়েছে। বই শেষে আমিও মংলুর মতো রাগে থরথর করে কেঁপেছি। পত্রিকা ছিড়েছি একটানে। একদমে এক নিঃশ্বাসে গালিগালাজ করেছি। তবুও পুরো ক্ষোভ উগরে দিতে পারিনি। পারবো কিনা জানিনা।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের মাঝে যে গর্ব! লেখক তা পুরা ভেঙে দিয়েছেন।ঘৃণা করাতে বাধ্য করিয়েছেন আমাকে! আমরা কি সত্যিই এই স্বাধীনতা, এই দেশটা, ঠিক এমন ভাবে চেয়েছিলাম?
নাকি অন্যকিছু? সেটাই বা কি?
-আমি তো এখন তোমার ভাঙ্গা আয়না, আমারে ফ্যালাইয়া দিবা?
-গরিব মানুষরা ভাঙা আয়নাতেই মুখ দেখে।
বুক ভরা কষ্ট নিয়ে আয়নার মতো আমিও চোখের জল মুছতে চেয়েছি।
ধরন-উপন্যাস
পৃষ্ঠা-১৯২
মুল্য-২২০ টাকা
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স
ভাদ্র মাসের বৃষ্টি যেমন, গল্পের চরিত্র মংলুর ভাগ্যটাও তেমনি। ভাদ্র মাসের বৃষ্টিকে লোকে বলে "উড়াবৃষ্টি"। ঝড়ের মতোই উড়ে আসে ঘন্টাখানেক ইচ্ছা মতো নাচানাচি করে আবার হঠাৎ করেই উধাও। এই বৃষ্টির জলখেলা কেউই বুঝতে পারে না। মংলুর ভাগ্য-আকাশ তেমনি, ঝড়ো দুঃখ-সুখের লীলায় পরিপূর্ণ। একটুখানি সুখরৌদ্রের দেখা পেলেই দুঃখের মেঘ ছুটে আসে।
মংলুর জন্ম হয়েছিলো কোন এক মঙ্গলবারে। সেকারনে তার নাম রাখা হয় মঙ্গল। কিন্তু এ নাম বিকৃত হয়ে হয় "মংলু"।
জগৎ সংসারে সে একা। বাবার মৃত্যুর কাহিনী মায়ের কাছে শুনেছে বহুবার। বাবার চেহারা তার মনে পড়ে না। সাত আট বছর মাকে পেয়েছিলো। এক সময় মাকে হারায় ব্রক্ষ্মপুত্রের কোলে। অন্যের আশ্রয়ে বড় হয় অনাথ মংলু।
যৌবন কালে সে ছিলো অসুর শক্তির অধিকারী। ছয় ফুট লম্বা যুবকের চওড়া বুক।গায়ের রং অধারের মতো কালো। পেটানো শরীর। মাথায় বাবরী। হা-ডু-ডু খেলায় জুড়ি মেলা ভার! চোখদুটো তীক্ষ ছোট ছোট। রেগে গিয়ে সে যদি কাউকে চড় মারতো, সাথে সাথে লোকটা নিচে পড়ে যেতো। ছিলো একগুয়ে।জিদ আর গোয়ার্তুমিতে সেরা।কিন্তু তার বাঁশিতে সুর উঠতো অসাধারণ! সে সুরের গুনে পেয়েছিলো তার আয়নাকে।
মুক্তিযোদ্ধা ছিলো এই মংলু। একজন নিরক্ষর বকলম মুক্তিযোদ্ধা, যে ক্ষেত খামারের দিন-মুজুরির কাজ ফেলে চলে গিয়েছিল যুদ্ধে। অন্তঃসত্ত্বা বউকে রেখে গিয়েছিলো অন্যের আশ্রয়ে। তার ছ'ফুট লম্বা কালো কুচকুচে চেহারা দেখলেই মিলিটারীরা চমকে উঠত।
এই গল্পটা মংলুর, মংলুর আয়নার, মংলুর স্বাধীনের। প্রতি পাতায় ছেয়ে আছে এক গেয়ো, গুয়ার দিনমজুরের আঁচড়। নখের আঁচড়ের ক্ষত থেকেও এ যন্ত্রণার তীব্রতা অধিক! একজন এতিম অনাথ মুক্তিযোদ্ধার দিনলিপি। যাকে মুক্তিযোদ্ধা বলে সবাই সমীহ করে চলত। কেউ কাজ করতে দিতো না, পাছে সম্মানে ভাটা পরে। যাকে দেখার জন্য মৃতপ্রায় এক বৃদ্ধ বেঁচে ছিলো তিন দিন। যাকে ছু্ঁয়ে দেখার স্বাদ ছিলো গেয়ো অশিক্ষিত গ্রাম্যলোকগুলোর ! উপন্যাসের পাতা জুড়ে সেই অসহায় মুক্তিযোদ্ধার আলাপে পরিপূর্ণ। সে তার সন্তানকে কসম করিয়েছিলো, কোন দিন যেন কেউ জানতে না পারে তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এ কথা যেন সে বলে না বেড়ায়। এত অভিমান! এত আক্রোশ! কিন্তু কেন?
ছ'ফুটের চওড়া বুকের অধিকারী মংলু আড়াল হতে চেয়েছিলো এই নাম মাত্র উপাধি "মুক্তিযোদ্ধা"র খোলশ থেকে।
আমজাদ হোসেন। তিনি ছিলেন অভিনেতা, লেখক এবং ব্যতিক্রমধর্মী চলচ্চিত্রকার। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন কিশোর। উনসত্তুরে গনঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তিনি প্রতক্ষ্য ভাবে জড়িত। তার লেখা চলচ্চিত্র " জীবন থেকে নেয়া" মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ যুগিয়েছে বিপুল ভাবে। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন "বাংলা একাডেমী পুরস্কার"।
উত্তরকাল এর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত! যেমন তার ভাষাচিত্র, তার থেকে মনোহর বর্ণনাভঙ্গী। এত পরিপাট্য আর সাবলীল গতি প্রশংসার দাবী রাখে অবশ্যই। লেখকের কলমে এত সুন্দর করে ফুটে উঠেছে প্রকৃতি এবং চরিত্র গুলোর বাস্তব চিত্র!
পোড় খাওয়া সংগ্রামী মানুষের চিত্র এঁকেছেন লেখক।
প্রথম পাতাতেই আটকে ছিলো চোখ অনেকক্ষন, " একটানা ক'দিন ঝুপঝুপা বৃষ্টির পরে, গ্রামগঞ্জের কারো কারো কাছে আজকের ঝলমলে রূপালী রোদ সোনার চেয়েও দামি মনে হচ্ছে।"
আমার মতো আবেগপ্রবণ পাঠককের চোখে জল আনা লেখকের কাছে কোন ব্যপারই ছিলো না। ক্ষোভ আরও চড়ে গিয়েছিলো একারনে যে, আমি নিজ থেকে উপলব্দি করতে পেরেছিলাম, আমি যা পড়ছি তা একবিন্দু মিথ্যা নয়। ঠিক তাই ঘটেছে, এবং একবার নয় বহুবার, বহুবার। হয়তো জায়গা আর চরিত্র বদল হয়েছে। বই শেষে আমিও মংলুর মতো রাগে থরথর করে কেঁপেছি। পত্রিকা ছিড়েছি একটানে। একদমে এক নিঃশ্বাসে গালিগালাজ করেছি। তবুও পুরো ক্ষোভ উগরে দিতে পারিনি। পারবো কিনা জানিনা।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের মাঝে যে গর্ব! লেখক তা পুরা ভেঙে দিয়েছেন।ঘৃণা করাতে বাধ্য করিয়েছেন আমাকে! আমরা কি সত্যিই এই স্বাধীনতা, এই দেশটা, ঠিক এমন ভাবে চেয়েছিলাম?
নাকি অন্যকিছু? সেটাই বা কি?
-আমি তো এখন তোমার ভাঙ্গা আয়না, আমারে ফ্যালাইয়া দিবা?
-গরিব মানুষরা ভাঙা আয়নাতেই মুখ দেখে।
বুক ভরা কষ্ট নিয়ে আয়নার মতো আমিও চোখের জল মুছতে চেয়েছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন