বুধবার, ১ মার্চ, ২০১৭

বই-কমলাকান্ত

লেখক-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায়
ধরন-রম্য ও ব্যঙ্গ
পৃষ্ঠা-১৮০
মূল্য-২০০
দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড প্রকাশনী। 
কমলাকান্ত একটু পাগল প্রকৃতির। কিন্তু লেখাপড়া জানে। এমন কি ইংরেজী ও সংস্কৃত জানে। অথচ সে বিদ্যায় তার অর্থ উপার্জন হয় নি। তার ইংরেজী শুনে সাহেব তাকে ডেকে কেরানিগিরির চাকরি দেয়। সে অপিসে গিয়ে অপিসের কাজ করত না। সরকারি বইয়েতে কবিতা লিখত। বিল বইয়ের পাতায় ছবি আকত। সাহেব এগুলো দেখে তার চাকরিচ্যুত করে।কমলা কান্ত বিয়ে করে নি । দিনের মধ্যে একটু খাবার আর আফিম হলেই তার চলে যায়। পাগল বলে প্রকাশক শ্রী ভীষ্মদেব খোশনবীস তাকে কিছুটা যত্ন করত। অনেক দিন সে তার বাড়িতে ছিল। কিন্তু কমলাকান্তের এক জায়গায় বেশিদিন ভালো লাগত না। একদিন সে এ জায়গা থেকে উধাও হয়।কমলাকান্ত খুব লেখালিখি করত। একটু কাগজ পেলেই লিখত। সে চলে যাবার পর তার পান্ডুলিপি প্রকাশকে উপহার দিয়ে যায়। তার ঘরে গিয়ে প্রকাশক লেখা গুলো আবিস্কার করে। তার আগে এই লেখাগুলো যখন কমলাকান্ত তাকে পড়ে শুনাত তখন তার খুব ঘুম পেত। একবার ভাবল কাগজ গুলো পুড়ে ফেলবে। কিন্তু তার যেহেতু অনিদ্রায় কাজ করে তাই, সে এগুলো প্রকাশ করল যাতে অনিদ্রায় ভুগতে থাকা লোক গুলোর কিছুটা সুবিধা হয়। এটাই হলো কমলাকান্ত দপ্তর। মানুষের উপকার করার লক্ষে প্রকাশক তা ছাপান।
বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত তিন খন্ডে রচিত। গ্রন্থের শুরুর খন্ড টি হলো "কমলাকান্ত দপ্তর" এখানে ১৪ টা সংখ্যা ১৪ টি শিরোনামে রচিত। যেমন-
১.একা কে গায় ওই
২.মনুষ্যফল
৩.উদর দর্শন
৪.পতঙ্গ
৫.আমার মন
৬.চন্দ্রোলোকে
৭.বসন্তের কোকিল
৮.স্ত্রী লোকের রূপ
৯.ফুলের বিবাহ
১০.বড় বাজার
১১.আমার দুর্গোৎসব
১২.একটি গীত
১৩.বিড়াল
১৪.টেকি
এরপর হলো "কমলাকান্তের পত্র" এটি পাঁচ টি শিরোনামে রচিত। যেমন- ১.কি লিখিব
২.পলিটিকস
৩.বাঙালির মনুষ্যত্ব
৪.বুড়ো বয়সের কথা
৫.কমলাকান্তের বিদায়
তিন নাম্বার টি হলো "কমলাকান্তের জবানবন্দী।"
পরিশিষ্ট- কাকাতুয়া (শ্রী কমলাকান্ত চক্রবর্তী প্রনীত)
কমলাকান্ত বঙ্কিমের বহুলখ্যাত গ্রন্থ। যার তিনটি অংশ। বঙ্কিমের রহস্যপ্রিয় মন। কিন্তু সবসময় সস্তা রহস্য তৈরিতে তার মন তৃপ্ত ছিলো না। তাই প্রবাহমান সংসার জীবনের গভীর রহস্যের অভ্যন্তরে তলিয়ে যেতেন। পাগল টাইপের নেশাখোর কমলাকান্তর মাধ্যমে তার অনুউচ্চারিত কথাগুলো প্রকাশ করেছেন। যা তিনি সরাসরি বলতে সংকোচ বোধ করতেন। আর এই রহস্যময় পাগলের দ্বারা তিনি মাসের পর মাস পাঠক ভুলাতেন।
কমলাকান্ত একাধারে কবি, দার্শনিক, সমাজ শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও স্বদেশ প্রেমিক। বঙ্কিম তার অসাধারণ প্রতিভায় এর রচনা করেছেন। কি মাধুর্য তার ভাষায়! ভাবের কি মনোহর দৃশ্য! সহজ সংযত রসিকতা! তাছাড়া অকৃত্তিম দেশ প্রেম! সব মিলে অনন্যা। হাসির সাথে বেদনার, সহজতার সাথে যে যন্ত্রনাময় কাহিনী, নেশার সাথে দার্শনিকতা, ভাবের সাথে বাস্তবতার, কৃত্তিময়তা সাথে উদারতার অসাধারণ দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
রম্য যেমন হাসায়, এই হাসির সাথে সমাজের অসঙ্গতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এমনি কমলাকান্তের দপ্তরে , মানুষ্য ফলে মানুষের ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তার মতে, "তুমি যদি অন্যকে ভালো না বাসো, অন্য কেউ যদি তোমাকে ভাল না বাসে তবে তোমার মানুষ্য জন্ম বৃথা।" নারীকে তিনি নাড়িকেল এর সাথে তুলনা করেছেন। তার মতে যৌবনে সব কিছু ভালো লাগে। কিন্তু বয়সের ভারে তা কমে আসে। সুতরাং "বয়সের প্রফুল্লতা, সুখ, স্ফুর্তি কমে যায়।"
কমলাকান্ত ধারনা করে মানুষ মাত্রই পতঙ্গ। আমার মন প্রবন্ধ অনুসারে স্থায়ী সুখের উপায় দেখিয়েছেন। চাঁদকে তিনি তার সাথে বাসর করতে অনুরোধ করেন। কোকিল প্রবন্ধে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়েছেন, "মানুষ সব বসন্তের কোকিল। সুসময়ে শুধু তার কু ধ্বনি পাওয়া যায়। অসময়ে তার টিকি টাও খুজে পাওয়া যায় না।" নারী কে শ্রেষ্ট করেছেন, রূপে নয় মহত্বের গুনে।বিড়াল গল্পেও সমাজের অসংগতি ধরা পড়েছে।তার মতে "অনাহারে মরিয়া যাইবার জন্য কেউ পৃথিবীতে আসে নি।" তা ছাড়া তার দপ্তর টি কিভাবে প্রকাশ পেয়েছে তাও এক মজার কাহিনী। কমলাকান্ত বুঝতে পারে "কুকুর হলো সব থেকে বড় পলিটিশিয়ান।"
আর বাকি রইলো জবানবন্দী। তার সম্পর্কে আমরা সকলেই অল্প বিস্তর জানি। "বাবা কার ক্ষেতের ধান খেয়েছি যে আমাকে এর ভিতর পুরিলে?" এই একটা বাক্য পুরো রচনাকে সামনে এনে দেয়।
কমলাকান্ত একাধারে রম্য, ব্যঙ্গ। কমলাকান্তের জবানবন্দী অনেক জায়গায় নাট্যরূপে মঞ্চায়িত হয়েছে। তা ছাড়া সব গুলো অংশে লেখক সমাজকে এবং তাতে বসবাস করা মানুষের চরিত্রকে কেন্দ্রবিন্দু করেছেন। হাস্যরসে তাদের কর্মকান্ডের অসংগতি তুলে ধরেছেন। তাদের কার্যবলি কে প্রশ্ন বিদ্ধ করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা উপন্যাসে অাধুনিক ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাত।তিনি উনিশ শতকের সাংবাদিক এবং ঔপন্যাসিক। বাংলা গদ্য ও সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। তিনি বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র বঙ্গদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। তার ছদ্ম নাম হিসেবে তিনি কমলাকান্ত নামটা বেছে নিয়ে ছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন