শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

বই-শেষ চিঠি

লেখিকা-আয়েশা ফয়েজ
ধরন-পত্র উপন্যাস
পৃষ্ঠা-৬৬
মূল্য-১৬০
প্রথম প্রকাশ-২০১৭
প্রকাশনা-তাম্রলিপি
প্রচ্ছদ-আহসান হাবীব
...
এতটুকু মানুষের জীবন! এই এতটুকু সময়ে মানুষের কতো প্রাপ্তি!
সবাই চায় প্রিয় মানুষ গুলো ভালো থাকুক।  সবাই চায় আত্মার আত্মীয় তাকে ছেড়ে যাবার আগে যেন , তার মরণ হয়। কেন না একা বেঁচে থাকা যে খুব যন্ত্রণার!
আমার বাবা যিনি সেনাবাহিনীর মেডিকেল অফিসার ছিলেন। তিনি মারা যান হঠাৎ করে। বাবা রিটায়ার্ড করার পরও ময়মনসিংহ   সদরে ছয় বছর নিজ চেম্বারে রোগী দেখেছেন। আমার মা বলেন,  বাবার তেমন কোন রোগ ছিলো না।  কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ঔষুধ খেতেন,  আম্মু জানতে চাইলে বলতেন এগুলো তেমন কোন ঔষুধ নয়। নিজে যেহেতু ডাক্তার,  কোন ভুল হবার কথা নয়।  বাবা হঠাৎ শুকিয়ে যাচ্ছিলেন।  তখন  বাবা ডায়েট মেনে চলতেন। মায়ের কাছে তাতে কোন রকম কিছু মনে হয় নি।  কিন্তু আমার দাদী আম্মুর সাথে কড়া ভাষায় বলতেন, কেন আম্মু লক্ষ করছে না। কেন বাবা এভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। বাবাকে কিছু বললে, তিনি হাসতেন।  
বাবা চাকরি সুত্রে বহু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। এমন কি স্থায়ী হয়ে ছিলেন দেশের বাড়ি কিশোরগঞ্জ রেখে, এই ময়মনসিংহে। অথচ মারা যাবার ৭ দিন আগেই দেশের বাড়ি চলে যান।   আমার তখন ক্লাস সিক্সের ভর্তি  পরীক্ষা।  আমার এত কেয়ারফুল বাবা!  আমাকে বলেন, "মামুনি আমি তো তোমাদের সাথেই থাকি  ।  কয়েকদিন বাড়ি থাকবো তোমার বাবার যে কিছু কাজ আছে । "
জানি না কেন! তবে মৃত্যুই কি বাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো কিনা । রাতে  দাদীর সাথে ঘুমাতেন ।  আমার চাচী বলছেন,  সকালে উঠে নিজে রান্না করতেন আর বলতেন "মায়া তো আর কয়দিন বেঁচে  থাকবেন। আমি যতো দিন থাকবো তত দিন রান্না করে খাওয়াব।"
বাবার রান্নায় হাত বেশ ভালো ছিলো। মা ছেলে মিলে রান্না করতো।তিনি আরো বলতেন, "তোমারা মায়ার জন্য কিন্তু কিছুই রান্না করবে না।"
তার পাঁচ দিন পর বাবা মারা গেলেন।  স্ট্রোক করার পাঁচ মিনিট আগেও কেউ জানতো না লোক টা মারা যাবে!  মারা যাবে বলেই কি সে তার মায়ের আচলে চলে গিয়েছিলো?!  আমার আম্মু তখন বাবার সাথে রাগ করে আছে।  কেন না মেয়ের পরীক্ষা, এখন তিনি বাড়ি গিয়ে বসে আছেন।   মেয়ে যে তার বাবাকে ছাড়া একদম পড়ে না! সে রাগে বাবার মৃত্যুর আগের দিন থেকেই আম্মু কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মারা যাবার দিন সকালে আব্বু কল দিলেও আম্মু কল রিসিভ করে নি।  সে দিন সকাল এগারটায়  আমার ফুফা কল দিয়ে জানায় বাবা অসুস্থ হয়েছেন।  তারপর তো ছুটোছুটি।  সারা দিন বাবা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে সন্ধ্যা ৭:২৭ মিনিটে মারা গেলেন।মারা যাবার সাত দিন আগে আমার সাথে তার শেষ দেখা হয়েছিলো। বাড়ি যাবার আগে আমাকে দুইটাকা দিয়ে গিয়েছিলেন চানাচুর খাবার জন্য। হায়রে পাগল আমি পিতাহারা হব তা যদি জানতাম!  আর আমার মা যদি জানতো! না জানি সকালে কি বলতে চেয়েছিলেন!

এরপর কতদিন গেল! আমি কাউকে বাবা ডাকি নি!    বাবা মারা যাবার পর আরো তিন বছর আমার দাদী বেঁচে ছিলেন,  তাও অসুস্থ অবস্থায়।  কেউ দাদীকে দেখতে এলেই বলতেন, আমি জানালা দিয়ে আমার ছেলেটাকে দেখি কিন্তু কাছে যেতে পারি না, ছুয়ে দেখতে পারি না।  আমার ছেলেটা কত লোকের রোগ সারিয়েছে অথচ তার কি হয়েছিলো যে ডাক্তারদের একটু সময়ও দিলো না দেখার জন্য! কি এমন হয়েছিলো,  মৃত প্রায় মাকে রেখে তার চলে যেতে হলো । তার ছোট ছোট ২ টা বাচ্চা  কি করে বেঁচে থাকবে।  কত কষ্ট পাবে পিতাহারা সন্তান গুলো!

বেঁচে থাকা বড় কষ্ট বাবা!  খুব কষ্ট! 
প্রিয়জন যারা হারিয়েছে তারাই শুধু জানে বেঁচে থাকাটা কত কষ্টের! 

শেষ চিঠি , হুমায়ুন আহমেদ এর মা আয়েশা ফয়েজ এর একটা ডায়েরী।   যেখানে তিনি  তার মৃত সন্তানকে চিঠি লিখেছেন। কষ্ট জানিয়েছেন, অভিযোগ জানিয়েছেন।  স্মৃতিচারণ করেছেন, আক্ষেপ করেছেন।  হতাশার কথা,  তার অপরাগতার কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, "আমার এত আদরের বাচ্চাটি আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় গেলে?  বাবা তোমার কি মনে হয় নাই যে তোমার একটা দুঃখী মা আছে, একটা সুন্দর দেশ আছে,  তোমার ভাইবোন গুলো তোমার আশায় দেশে অপেক্ষা করেছে ।  দেশের মানুষ তোমাকে কী-ই না ভালোবাসে!  তোমার ফুলের মতো বাচ্চাগুলোকে রেখে চলে যেতে  তোমার কষ্ট হয় নাই?"

কী কষ্ট!  আহা কী কষ্ট! একদিকে মা,  অন্যদিকে ছেলে মাঝখানে একটা পৃথিবী এর থেকে বড় কষ্ট বুঝি আর কিছু নেই!
তিনি তার ছেলের ছোট বেলা, বড় বেলা,তার  নাতি নাতনীর সবার কথা বলেছেন। তার বড় ছেলেটা যে অন্য সব ভাই বোন দের কাছে বাবার মতো সম্মান পেতেন,  বাবা ফয়জুর রহমান তাকে "বাচ্চুনী বড় ব্যাটা" বলে ডাকতেন। সেগুলোও।
তিনি জানতে চেয়েছেন, বাবার সাথে তার দেখা হয়ছে কিনা? জানতে চেয়েছেন মৃত আর কোন আত্নীয় এর সাথে তার দেখা হয়েছে কিনা! 
বলেছেন, তিনি যে এক অসাধারন ছেলের খুব সাধারণ মা।   তিনি তার ছেলের কাজ গুলো সমালোচনা করে, ছেলের কাছেই জানতে চেয়েছিলেন, কাজ গুলো সে ঠিক করেছে কি না।  আরো, আরো কত শত গল্প করেছেন তাঁর ছেলেকে নিয়ে।
বার বার বলেছেন,  "তোমার এই একটা জীবনে তুমি কত কী করলে।  বই লেখালেখি,  ছবি বানানো, সবাইকে নিয়ে দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ানো,  ভাই বোনদের বিয়ে দেয়া, বাড়ি বানানো,  বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকতা,  আরো কত কী! "
তিনি আক্ষেপ করেছেন,  তার অসুস্থ ছেলের জন্য তিনি কত কিছুই না করেছেন! তিনি হয়তো  প্রকৃত মা হতে পারেন নি তাই তার দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয় নি।  তিনি নিজের মৃত্যু নিয়ে একটা ছবি এঁকেছিলেন চোখে, কিন্তু পুত্রের মৃত্যুতে সেই ছবিটা নষ্ট হয়ে গেছে।

কারো কারো জন্য জীবন বড় অসহায়,  জীবন বড় কঠিন,  বড় নিষ্ঠুর। 
তিনি আফসোস করে বলেছেন,  তার মতো হতভাগ্যদেরই দীর্ঘায়ু হয়!
তিনি হুমায়ুন আহমেদ এর স্ত্রী গন আর সন্তানদেরকেও নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। নুহাশ কে বলা হয়নি তার দুঃখী বাবাকে যেন সে ক্ষমা করে দেয়। বার বার জানতে চেয়েছেন,  যেখানে ডাক্তারদের কথা মতো তার ছেলে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও, কেন আবার সে মৃত্যু পথে যাত্রা করলো!  কি এমন কারন ছিলো!  আরো কতো শত কষ্ট আর যন্ত্রণার আক্ষেপ ছিলো পুরো বইটাতে! 

শেষ চিঠি বই টা পড়ব,  অনেক দিন আগে থেকেই খুব ইচ্ছা।  একজন দুঃখিনী মায়ের অশ্রু জলে লেখা ডায়েরী এটা। পড়েছি আর অনুধাবন করেছি।  এত কষ্টের সময়ও আমরা পার করি। স্বামী মারা যাবার পর দৃঢ় মনুষত্বের অধিকারী এই মহিলাটি কতো আঘাত প্রতিঘাত নিয়ে সময় পার করেছেন।  তাঁর বড় ছেলের প্রতি তার অভিমান অভিযোগ সব ছিলো এই পৃষ্ঠা গুলোতে।  আমরা যারা আত্মার আত্মীয়জন নিয়ে সুখে জীবন যাপন করি,  তারা কখনো উপলব্দি করতে পারব না এই আত্মাগুলো ছেড়ে জীবন পাড়ি দেওয়াটা কতো কষ্টের! কত যন্ত্রণার! কতো যন্ত্রণার! আমি কেঁদেছি , কাঁদব আরো অনেক অনেক দিন পর্যন্ত! যতো দিন বেঁচে থাকবো।হুমায়ুন আহমেদ এর মৃত্যুর পর নুহাশ কিছু লিখেছিলো তার বাবাকে নিয়ে,পিতাহারা সন্তানের সে কি আকুতি! আমি সেদিনও ঘুমাতে পারি নি। আমার থেকেও কত যন্ত্রণায় সময় কাটাতে হয়েছে তাকে!

হুমায়ুন কে নিয়ে অনেক পাঠকের মাঝে দ্বন্ধ তিনি সাহিত্যিক কিনা!  বোকার মতো এই সমালোচনায় যুক্ত হওয়ার তো কোন মানে হয় না। তিনি নিজেকে কখনো কোন কিছু বলে দাবী করেন নি। এখন পর্যন্ত তার মতো পাঠক তৈরি করতে পারেনি, কোন কবি বা সাহিত্যিক। তার মতো এত সহজসরল ভাবে জীবন উপস্থাপনও করতে পারেন নি কোন লেখক। আমি বলতে চাই না সে একজন সাহিত্যের বড় তারকা। আমি এটা বলব,  সে তার মায়ের কাছে অসাধারণ সন্তান। তার পাঠক দের কাছে উজ্জল নক্ষত্র। এই আলোচনায় সাহিত্যের মতো এত বড় বিষয় নিয়ে তর্ক করতে চাই না কখনই। কেন না সে কি,  তা আমি জানি। দোষে, গুনে মানুষ।  তার  বিচার করা আমার কাজ নয়।  সে আমাকে যতোটুকু দিয়েছে আমি তাই গ্রহন করেছি।

এই বইয়ের মান নির্ণয় করা আমার পক্ষে অসম্ভব। এটার রেটিং আমি কোনদিন দিতে পারব না।  রত্নাগর্ভা এই অসাধারণ মহিলার শেষ বই এটি।  এর আগে তিনি একটা বই লিখেছিলেন। নাম ছিলো, "জীবন যে রকম"। এই পৃষ্টা গুলোকে যদিও বই আকারে রূপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটা বই নয়। প্রিয় পুত্রকে নিয়ে লেখা চিঠি। বইয়ের ভূমিকায় কিছু লেখা,  যা আমাকেও অসহায় করে দিয়েছিলো।জানি না বৃদ্ধা কিভাবে সামলেছেন! পৃষ্ঠার ভেতরের কিছু কাহিনীর বিবরণ আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। বইটি প্রকাশের তিক্ত অভিজ্ঞতায় মেজাজ চড়ে গিয়েছিলো।  একজনের প্রতি রাগ হয়েছে ভীষণ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন