শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

বই-ল্যেভ তলস্তয় এর দুটি বড়ো গল্প

গল্প-ইভান ইলিচের মৃত্যু(১৮৮৬)
লেখক-ল্যেভ নিকলায়েভিচ তলস্তোয়/ লিও টলস্টয়
ধরন-অনুবাদ গল্প
অনুবাদ- সমর সেন
পৃষ্ঠা-১৩০
প্রকাশ-২০১৪

[স্পয়লার এলার্ট]

কোন ব্যক্তি তার জীবন সম্পর্কে ধারনা থেকে বুঝে নিল, সমাজের নিয়ম বা নীতি বলে যে সব কর্ম সে সম্পাদন করেছে তার কিছুই ঠিক করেনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সময় গুলোর জন্য আফসুস হচ্ছে। সে এমন এক স্থানে দাড়িয়ে আছে,  যেখান থেকে পিছনে তাকানো বা ভুল গুলো শুধরানোরও কোন উপায় নেই। এমন কি সে এটাও জেনে গেছে তার হাতে সময় খুবই অল্প বা নাই বললেই চলে। যেটুকু আছে তারও কোন মূল্য নেই তেমন! মানুষটার  এই অব্যক্ত   যন্ত্রণা লাগবের উপায় কি কিছু আছে?  
ভাবুন তো লোকটার কি অবস্থা! কতো ভালো আছে সে!

একটা গল্প শুরু করেছেন এটা জেনেই যে,  গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রটির মৃত্যুই গল্পের সারাংশ।  আপনার কেমন লাগছে তখন? 
এমন কি ধরুন গল্প শুরু করেছেন  কিছু না জেনেই। কিন্তু দুয়েকটা লাইন যাওয়ার পর মৃত্যু সংবাদ পেলেন এমন একজনের যিনি কিনা গল্পের মূল চরিত্র! আপনি আরো বেশি চমকে যাবেন,  এ ব্যপারে লেখকের সরল উক্তি গুলোর মধ্য দিয়ে!

ইভান ইলিচের মৃত্যু! গল্পের নামেই স্পয়লার! পাঠক মাত্রই জানবেন লোক টি মারা গেছে।  একটা মৃত লোকের গল্প পড়ছি আমরা!   এতটা জানার পরও বই টা আপনার যে আকর্ষনটা  ধরে রাখবে,  তা হবে মৃত্যু সংবাদের এই সারল্যতা!  মৃত্যুর মতো একটা ভয়ংকর খবর লেখক এভাবে হেলায় ফেলায় বলে দিতে পারেন! 

ঊনবিংশ  শতাব্দীতে রাশিয়া সরকারের এক কর্মকর্তার দ্বিতীয় সন্তান হলেন ইভান ইলিচ। লেখক তার বর্ণনায় বলেছেন, "ইভান ইলিচের জীবন কাহিনী খুবই সহজ ও সাধারণ এবং খুবই ভয়াবহ!" 
ঠিকই দেখেছেন,  লেখক তার জীবনে তিন নং বিশেষণে ভয়ংকর রূপী ভয়াবহ'কে ব্যবহার করেছেন।   ইভান ইলিচ আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এবং সসম্মানে উত্তীর্ণ হন সকল পরীক্ষায়। আইনের ছাত্র হিসেবে তিনি যেমন ছিলেন,  তেমনি কাটিয়েছেন বাকি সময়; দক্ষ, হাসিখুশি,  দিলরাজ ও মিশুক। নিজে যা ভালো মনে করতেন তা আর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা যা কর্তব্য বলে মনোনীত করতেন,  শুধু মাত্র সেগুলোই তিনি সম্পাদন করতেন। তিনি বিচারকমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। বিয়ে করেছেন 'প্রাসকোভিয়া ফিওদরভনা মিখেল' নামক  ধনী ও সুন্দরী নারীকে।  তবে সেটা সমাজের নিয়মে আর দশজন করে বলেই করা।  তাদের দুই ছেলে মেয়ে। ছেলে ভলোদিয়াকে আইন পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্ত্রীর আপত্তি তাই সেটা আর হয়নি। তার বদলে ছেলে জিমনেশিয়ামে ভর্তি হলো। একজন সাধারণ মানুষের সকল চাওয়া পাওয়ার সংমিশ্রন ছিলো ইভানের সংসারে।  উপযুক্ত চাকরি, সুন্দরী স্ত্রী, একটা সুন্দর ঘরের স্বপ্ন ছিলো তার।  তবে শেষ পর্যন্ত পুরণ হয়েছিলো সব। সমাজের নিয়ম মাফিক মানুষ হিসেবে যা করনীয় তা বেশ ভালো ভাবে সম্পূর্ন হয়েছিলো তার। 

আদালতের হাকিমরা সবাই অভিশংসকের সঙ্গে জড়ো হলেন ইভান এগরভিচ শেবেকের দপ্তরে।  কথা হচ্ছিলো ক্রাসভ মামলা নিয়ে।  তার মাঝেই জানা গেল ইভান ইলিচের মৃত্যু সংবাদ!   সেখানে জড়ো হওয়া ব্যক্তিবর্গের সবাই ইভান ইলিচের সহকর্মী।  তারা তাকে ভালো জানতেন। তবে আলোচনার বিষয়বস্তু তখন তার মৃত্যু নয়। বিষয়বস্তু ছিলো তার জায়গা পূরণের জন্য কে তার জায়গায় স্থানন্তারী হবেন। এবং তার বেতন বা সুযোগ সুবিধা কতটা হবে তার হিসাব নিয়ে। সেই সাথে আরেক টা কথা ভেবে খুশি হলো যে -তাঁদের অতি পরিচিত ব্যক্তিটি মারা গেছে ঠিকি, কিন্তু তাঁরা এখনো বেঁচে আছেন।  ইলিচ মারা গেছেন বলেই মনে হলো তার বিধবা স্ত্রীকে সমবেদনা জানানোর এবং শেষকৃত্যে সামাজিকতার ক্লান্তিকর কর্তব্যটা এল!

"মৃতদেহটি শুয়ে আছে জগদ্দল একটা ভঙ্গিতে, সব মৃতদেহ যেমন;...তবে তার মুখ দেখতে হয়ে উঠেছে জীবদ্দশার চেয়ে আরো বেশি সুন্দর, বিশেষ করে আরো ভাবব্যঞ্জক। মুখের ভাব জানিয়ে দিচ্ছে যা, তা করা হয়েছে সঙ্গতভাবে। আরো একটা জিনিস রয়েছে মুখের ভাবে- জীবিতদের প্রতি ভৎসর্না বা হুশিয়ারি।"
কিন্তু এই হুশিয়ারি ঠিক কাজে দিচ্ছে না।

প্রতিক্রিয়া জানাতে বলতে হয়,  গল্পের শুরুটা বেশ সহজ। আড্ডা দেওয়ার মাঝে ইলিচের সহকর্মীরা জানতে পারলেন ইলিচ মারা গেছে। এটা বেশ স্বাভাবিক।  মৃত্যুই সকল কিছুর সমাপ্তি। যা হোক,  এই ভেবে স্বস্তি পেলেন ইলিচ ই মারা গেছে কিন্তু তারা নিজেরা বেঁচে গেছেন! আড্ডার মুখ্য বিষয় তখন তার মৃত্যু সংবাদ নয়।  মুখ্য বিষয় হলো তার মারা যাবার ফলে   পদের যে রদ বদল হবে তা নিয়ে। নিজেদের পদন্নোতি নিয়ে। স্বার্থপর মানুষ হিসেবে আমরা তার থেকে আর কি আশা করতে পারি?

তার শেষকৃত্যে বন্ধু ও সহকর্মীর প্রবেশ কিন্তু বেশ দায়সারা ভাবেই। কেন না, তা নাহলে  সামাজিকতা রক্ষায় নাম থাকে না। বিধবাকে সান্তনা দেওয়ার সময় বন্ধুটির মনে হচ্ছিল, ইভান ইলিচের মৃত্যু  তাদের প্রতিদিনের সন্ধ্যার আড্ডা বিরত রাখার মতো তেমন কোন কারণ নয়!  বন্ধুই বটে।

গল্পের মূল সুর ছিলো এখানেই,  সমাজের নিয়ম মেনে আমাদের যা কিছু করা তা মূলত নিজের জন্য কিছুই না।  এতে শুধু মাত্র অনুভূতি গুলো ভোঁতা হতে থাকে।  সমাজের নিয়মে ইলিচ সব করেছে। এমন কি বিয়েটাও। কিন্তু গল্পেই দেখা গেছে স্বামী মারা যাবার শোক ঠোটে ঝুলিয়ে রেখে  স্ত্রী তার পতিবন্ধুর সাথে পরামর্শ করছেন কিভাবে কোন কৌশলে মৃত্যুকে পুঁজি করে পেনশনের টাকা কিছু বেশি আদায় করা যায়। এমন কি তাকে সমাহিত করার জন্য কোথায় সস্তা দরে জমি পাওয়া যাবে।

গল্পে    ইভান ইলিচ কে দেখতে পাই জীবিত থেকেও মৃত। এমন কি পাঠক মাত্রই এটা মানবেন,  মৃত্যুটা ছিলো ইলিচের জন্য মুক্তি। কেন না সে শুধু জীবন ভর অর্জনের পিছনে ছুটেছে ভোগ ততটা করতে পারেনি।  দেখা যায় কর্মব্যস্ত দিন গুলোতে সে আত্মার থেকে কাজকেই বেশি মুল্য দিয়েছে। আর এভাবে সে আত্মার আত্মীয় গুলো থেকে সে দূরে চলে গেছে। নিয়ম মেনে চলেছে, যা ছিলো সবই লোক দেখানো। ভালোবাসেনি সে কাউকে। বা বাসতে পারে নি।  মৃত্যুর আগে তাকে সময় পার করতে হয়েছে একা, নিঃস্ব আর অথর্ব হয়ে । প্রতিটা মানুষ কিন্তু এমনি।

একসময় নিজেকে যেখানে খুব প্রয়োজনীয় মনে করত,  সে বেঁচে থাকতেই দেখেছে সেখানে তার কোন প্রয়োজন নেই।  এমন কি তার অভাবটাও বোধ করছে না কেউ। একটা সময় সে মেনে নিয়েছে কর্তব্য ভেবে যা সে সম্পন্ন করেছে।  তাতে সে নিজেকে ঠকিয়েছে।  এবং তার সবটুকু সে করছে ভুল। একটা বড় চাকরি, বড় বাড়ি স্ত্রী সন্তান এগুলো তাকে সস্তি দিতে পারেনি মোটেও।  সে ঘর সাজিয়েছে নিজ হাতে খেটে খুটে, কিন্তু একাকীত্বের সময় গুলোতে এসব সঙ্গী হয় নি মোটেও। তার বিশ্বাস আনতে হয় এখানে, যে মৃত্যুই একমাত্র জীবনের সত্য উপলব্ধি। তার  জীবনে সম্মান আর কর্তব্য পালন করতে গিয়ে চারপাশে একটা দেয়াল তুলে ফেলেছিল। এমন কি খোড়া যুক্তিতে সে সড়ে গেছে তার আত্মার আত্মীয় থেকে।

আর তাতে সে শেষ অবস্থায় তার স্ত্রী আর কন্যার কাছে হয়ে উঠেছে বিরক্তির কারণ। তবে তারাও কর্তব্য পালন করেছে রুটিন মেনে। করতে হত বলে। ভালোবেসে নয়। তাদের ধারনা ছিলো এমন  ইলিচ নিজেই তার যন্ত্রণার জন্য দায়ী। যখন ইলিচের তাদের সঙ্গ প্রয়োজন ছিলো তখনই সে তাদের দুরত্ব বুঝতে পারে। এটাও বুঝতে পারে, সে সুস্থ বা অসুস্থ দুটোই পরিবারে সহনশীল হয়ে গেছে। তার ৪৫ বছরে মৃত্যু সংবাদটা ছিল বন্ধুদের কাছে একটা উল্লাস! 

একটা সহজ সরল অংকের মধ্য দিয়ে চলে যাই এক কঠিন সমীকরনে! মৃত্যুর ভয়াবহ তিনটি দিনের বর্ণনা ছিলো গল্পের অংশ!
নশ্বর জীবনে অবিনশ্বর হল একমাত্র মৃত্যু।যাকে এড়ানো মোটেও সম্ভব নয়। আর এই মৃত্যুভয় মানুষকে শান্ত করে দেয়।  বাধ্য করে শৃংখল এবং সীমার মধ্যে জীবন অতিক্রম করতে।  উশৃংখল আর মাত্রাহীন জীবন হতে বিরত থাকতে।
মৃত্যুর ভয়বহতা! একাকীত্বের মৃত্যু! কতটা নির্মম! তা স্বাভাবিক জীবিত মানুষ হয়ে অনুধাবন করা কষ্টকর। তা একমাত্র মৃত ব্যক্তির গোচর।
মাথা হিম করে দেওয়া অনুভূতি! সবটুকু গল্পে একমাত্র সান্তনার জায়গা ছিল চাকর গেরাসিমের কাছে। শান্তি পেয়েছিলাম, পুত্র ভলোদিয়ার মাথায় হাত রেখে ইভান যখন সুখ অনুভব করেছেন। মৃত্যু নিয়ে বই টা তাড়িয়ে নিয়েছে কয়েকটা রাত! একটু একটু করে পড়েছি দুইবার।

বেঁচে থাকাটা খুব স্বার্থপরের মতো। বাবা মারা যাওয়ার পরও আমরা তিনটি প্রাণী বেঁচে আছি খুব স্বার্থপরের মতোই। কেন না, লাঘব করতে পারিনি তাঁর মৃত্যু যন্ত্রণার কিছু অংশও। এর থেকে বড় উপলব্দি আর কি হতে পারে!
শেষ পর্যন্ত ইভান ইলিচের কাছে মৃত্যুটা ছিলো একটা আলো।  বই পড়ে গলা ব্যথা প্রায়ই হয়।  এবারো হয়েছে, তবে আশংকায়।

লিও টলস্টয় রুশ সাহিত্যের এমন কি বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। লেখকের জীবনী ও মৃত্যুর দশদিন পড়েও আমি অভিভূত হয়েছিলাম। দার্শনিক মনোভাব তার গল্পের মূল বিষয় বস্তু। ইভান ইলিচের মৃত্যু তার অন্যতম একটি গল্প।  যেখানে তৎকালীন সমাজের বিশ্বাস ও নীতিকেই চরম সত্য মেনে নিয়ে মানুষ হয়ে পড়েছে একা!  এড়িয়ে গিয়েছে মৃত্যুকে। কিন্তু মৃত্যু তো জীবনের পরম সত্য যা এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন