বুধবার, ১ মার্চ, ২০১৭

বই-জননী

লেখক-শওকত উসমান
ধরন-উপন্যাস
পৃষ্ঠা-১৯৫
মূল্য-২০০
সময় প্রকাশনী।
জননী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র দরিয়া । সে গ্রাম্য কৃষক আজহার এর দ্বিতীয় স্ত্রী। আবার আজহারও দরিয়ার দ্বিতীয় স্বামী। এর আগে একবার তার বিয়ে হয়েছিল সেখানে এক পুত্র সন্তান হবার পর তার স্বামীর মৃত্যু হয়। এর পর ছেলেকে তারা নিয়ে নেয় কিন্তু দরিয়ার ঠাই হয় নি। তাই তাকে আবার বিয়ে দেওয়া হয় মহেশডাঙার দরিদ্র কৃষক আজহার এর কাছে।
আজহার নিরীহ মানুষ। আজহার ও দরিয়ার পারিবারিক টানাপড়েন এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু।আজহারের পারিবারিক ঐতিহ্যে ওহাবীর বীরত্ব ও সাহসিকতার গৌরবউজ্জল ইতিহাস থাকলেও দরিদ্রের নির্মমতায় সে আজ পিষ্ট। সংসারে আছে সন্তানাদি আমজাদ, নাইমা ও আশ্রিত বৃদ্ধ খালা। স্ত্রী স্বামী দুজন মিলে সংসারের হাল ধরে তবুও কূল পাওয়া হয় না তাদের। তার উপর হঠাৎ করে দরিয়ার আগের পক্ষের সন্তান মোনাদি এসে আশ্রয় নেয়। এতে আরো লোক বাড়ে কিন্তু আয় নয়। তবুও তাদের কোন রকম চলে যাচ্ছিলো খড় কুটো ধরে। মহেশডাঙ্গার চন্দ্রোকোটাল হলো আজহার এর বন্ধু। হটাৎ আবার দরিয়া পোয়াতি হলো।
এক সন্ধ্যায় দরিয়া যখন পানি পানি বলে চিৎকার করছিলো তখন তখন বাচ্চা মেয়ে নইমা ছাড়া আর কেউ ছিলো না বাড়িতে। আজহার তখন মাঠ থেকে কষ্ট করে লাঙল নিয়ে ফিরেছে। স্ত্রীকে পানি দেওয়ার সময়ই আমজাদ আর মোনাদি বাড়ি ফিরে। তখন রাগের মাথায় আজহার, আমজাদ আর মোনাদি কে প্রবল ভাবে মারে। উঠানে ছেলেদের রক্তাক্ত দেহ দেখে জননী উত্তেজিত হয়ে জ্ঞান হারায়।
মোনাদির মা দরিয়া, কিন্তু আজহার তার বাবা নয় তাই আজহার এর হাতে মার খেয়ে মোনাদি রাগে দুঃখে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়। দরিয়া আজহার এর সাথে সংসার করলেও মোনাদির প্রতি তার অপরিসীম দরদ। তাই সন্তান এর এভাবে চলে যাওয়ার পর দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরে।
এর মধ্যে বাড়ি আসা শুরু করে আজহার এর ফুফাত ভাই ইয়াকুব। এভাবেই চলতে তাকে উপন্যাসের যাত্রা। এর পরিনতি ঠিক শেষের দিকে কি এনে দেয় তা পাঠক ই জানেন।
আজহার নিরীহ লোক কিন্তু রাগের মাথায় সে আমজাদ এর সাথে মোনাদীকে মারে। এটা সে নিজেকে তার পিতা জ্ঞান করে এবং মোনাদীকে সন্তান মনেকরেই করে। কিন্তু মোনাদির নিরুদ্দেশ হওয়ায় দরিয়া সংসারে আজহারের সাথে তেমন আর আকর্ষনবোধ করে না। দরিদ্র সংসারে কিছু বাড়তি উপার্জনের জন্য আজহার শহরে যায় কিন্তু ফিরে আসে শুন্য হস্তে। এর মধ্যে উপন্যাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চিত্র দেখা যায়। আর এতে বন্ধু চন্দ্রকোঠাল এর সাথে তার দুরত্ব বাড়ে।
দরিদ্র এর যাতাকলে পিষ্ট দরিয়ার জীবন তবুও সন্তানের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য সে তার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। জননী উপন্যাস কাহিনী নির্ভর নয়, চরিত্র নির্ভর। আর সেই কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো দরিয়া। উপন্যাসের শেষ দিকে ট্র্যাজেডি বিদ্যমান। এই উপন্যাসে দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের সংকটময় দিনের প্রতিলিপি এবং সহমর্মিতার চিত্র উচ্চকিত হয়েছে। আজহার এর খালা আসেকজান এর একটা করুন চিত্র আছে।
দারিদ্র্যের মধ্যে চন্দ্রকোটাল, আমিরন চাচী, সাকের পত্নীর সহমর্মিতার ও মমত্ত্বের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। দরিয়া চরিত্রের গাম্ভীর্যের মাধ্যমে উচ্ছলতা প্রকাশ পড়ে। স্বামীর দারিদ্র্যপূর্ন বৈচিত্র্যহীন সংসারে আনন্দের জীবন্ত প্রতিমা। সহজ সরল দরিয়া জটিল কঠিন কিছু বোঝে না। ভাগ্য বিড়ম্বিত নারী দরিয়া প্রথমে বিধবা হয়ে স্বামীগৃহে ছেলেকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করলেও সেখানে তার ভাগ্যে সুখ জোটে নি। তবুও সে তার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সব, সব সয়ে নিয়েছে।এমনকি স্বামীর অনুপস্থিতে তাকে ধান কাটতেও কোটালের শরণাপন্ন হতে হয়।লেখক মূলত তাকে জননী রূপে চিত্রায়িত করেছেন। মা সন্তানের জন্য কতটুকু করতে পারে বা করে থাকে এটাই লেখক দেখিয়েছেন।
আর্তসামাজিক চেতনানিষ্ঠা কথাশিল্পী শওকত ওসমানের জননী উপন্যাসে উঠে এসেছে ১৯২০ এর দশকের সময়কালে গ্রামের কৃষক পরিবারের জীবন চিত্রায়িত করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন